যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে Containment Policy: প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে Containment Policy: প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ
![]() |
| Containment Policy |
Containment শব্দটি ইংরেজি ভাষার একটি বিশেষ্য (noun), যার বাংলা পারিভাষিক অর্থ হলো আটকে রাখা, সীমাবদ্ধ করা, বেষ্টনী তৈরি বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। উৎসগতভাবে শব্দটি লাতিন ভাষা থেকে উদ্ভূত। এর মূল লাতিন রূপ “continere”, যার অর্থ থামিয়ে রাখা বা বাধা দেওয়া। এই “continere” শব্দটি দুটি অংশে বিভক্ত— “com-” অর্থাৎ একত্রে এবং “tenere”, অর্থাৎ ধরে রাখা। এই লাতিন শব্দটি ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্রিয়া “contain” এবং বিশেষ্য “containment” রূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। আধুনিক ইংরেজিতে containment শব্দটি এমন একটি প্রক্রিয়া বা কৌশলকে নির্দেশ করে, যার মাধ্যমে কোনো ঘটনা, শক্তি বা প্রভাবকে বিস্তার বা সম্প্রসারণ থেকে সীমাবদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণে containment শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War) পর্বে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে “Containment Policy” গ্রহণ করে। পরবর্তীতে, এই নীতি বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও কৌশলগত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
Containment Policy এর ইতিহাসঃ
মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান (George F. Kennan) প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে "Containment" বা "নিয়ন্ত্রণ" নীতির ধারণা উপস্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন, যা পরে "Long Telegram" নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে "Foreign Affairs" ম্যাগাজিনে "X" ছদ্মনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি এই ধারণাকে আরও সুসংগঠিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণবাদী কৌশলের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যেই এই Containment নীতির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কেনানের মতে, সোভিয়েত আদর্শিক ও ভূরাজনৈতিক সম্প্রসারণকে সামরিক সংঘাত নয়, বরং কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিরোধের মাধ্যমে ঠেকানোই হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশল। এই নীতিই পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত ও জোট গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
স্নায়ুযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছিল মূলত দ্বিমেরুকেন্দ্রিক (Bipolar World Order)। একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী পশ্চিমা জোট এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোট। এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে একটি সুসংহত কৌশলগত কাঠামোর মধ্যে পরিচালনার লক্ষ্যে মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান “কন্টেইনমেন্ট” তত্ত্ব উত্থাপন করেন। যদিও নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement, NAM) এই দ্বিমেরু কাঠামোর বাইরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবস্থান গঠনের চেষ্টা করে, বাস্তবতায় তারা ছিল তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক এবং প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকায় নিয়োজিত। ফলস্বরূপ, কন্টেইনমেন্ট নীতির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত সম্প্রসারণ রোধ, এবং এটি NAM-ভিত্তিক রাষ্ট্রসমূহকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়নি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা (Bipolar World Order) ভেঙে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন একমেরুকেন্দ্রিক (Unipolar World Order) ব্যবস্থার উত্থান ঘটে, তখন কন্টেইনমেন্ট তত্ত্বের কার্যকারিতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বহু বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন যে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সাথে সাথে এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতাও হ্রাস পাবে। কিন্তু, এই ধারণা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিশেষত, অধীনে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে কন্টেইনমেন্ট নীতি অনুসারে সাজাতে শুরু করে। তবে এবারে সোভিয়েত বা কোন রাষ্ট্র নয়, এবারে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুন ধরনের বৈশ্বিক হুমকিকে, যেমনঃ “সন্ত্রাসবাদ,” “দুষ্কৃতিকারী রাষ্ট্র” (rogue states), এবং “অজ্ঞাত সত্তা” (ambiguous entities)—কে টার্গেট করে পুনরায় কন্টেইনমেন্ট নীতিকে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই তত্ত্বের কার্যকারিতা, সীমাবদ্ধতা ও নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও তাত্ত্বিক বিতর্ক শুরু হয়।
Containment ধারণাটি স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের প্রশাসন (১৯৪৫–১৯৫৩) এই ধারণাকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি (doctrine) এবং বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের ন্যায়সংগত যুক্তি (rationale for external action) হিসেবে গ্রহণ করে। ট্রুম্যানের পরবর্তী রাষ্ট্রপতিরাও, বিশেষ করে লিন্ডন বি. জনসন (১৯৬৩–১৯৬৯), এই নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল একটি প্রতিরক্ষামূলক ও প্রতিরোধমূলক কৌশল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে নিজস্ব আদর্শিক প্রভাব ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। যেমন: এই ধারণার প্রস্তাবক মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান ইফরেন ম্যাগাজিন পত্রিকায় তাঁর বিখ্যাত “X” প্রবন্ধে লিখেছিলেন:
“The main element of any United States policy toward the Soviet Union must be that of a long-term, patient but firm and vigilant containment of Russian expansive tendencies.”
— X (Kennan), Foreign Affairs, 1947
এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে এফ. কেনান দীর্ঘমেয়াদে একটি কঠোর, সতর্ক ও কার্যকরী প্রতিরোধ নীতির পক্ষে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র কন্টেইনমেন্ট নীতি বাস্তবায়নে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত সম্প্রসারণ ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ বিস্তার রোধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রধান ক্ষেত্র ছিলো ইউরোপ ও এশিয়া। উদাহরণ হিসেবে মার্শাল প্ল্যান, ন্যাটো (NATO), CENTO, SEATO, Domino Policy ইত্যাদি গঠনের মতো উদ্যোগের প্রসঙ্গ টানা যায়।
এখানে কতিপয় উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্রকে Containment নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে মনোযোগী করেছে। যথা:


No comments